নীলফামারীর সৈয়দপুরের বোতলাগাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেয়ার নামে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়ে অগ্রীম বানিজ্য করেছে সভাপতি। আর এর খেসারত দিতে হয়েছে প্রধান শিক্ষককে। তাও আবার নিজের জীবন দিয়ে।
দীর্ঘদিন থেকে এই নিয়োগ বাণিজ্যের কথা লোকমুখে প্রচার হলেও প্রধান শিক্ষক আত্মহত্যা করার পর ব্যাপকভাবে চাউর হয়ে পড়ে ঘটনাটি। কিন্তু সভাপতি অর্থ নেয়ার কথা সম্পূর্ণরুপে অস্বীকার করে সব দোষ প্রধান শিক্ষকের উপর চাপিয়ে দেয়ায় চাকুরী প্রত্যাশিরা অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে পড়েছে চরম বিপাকে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, বোতলাগাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের এ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক ও বোতলাগাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বোতলাগাড়ী ইউনিয়ন জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আনিছুর রহমান মন্টুর জামাতা মোঃ মনিরুজ্জামান সরকার জুন আহ্বায়ক হওয়ার পর থেকেই প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রহমানের সাথে জোগসাজশ করে সহকারী শিক্ষকসহ পিয়ন পদে নিয়োগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর প্রেক্ষিতে সভাপতি নিজেই প্রার্থী সংগ্রহ করে তাদেরকে প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ করে। এমনই কয়েকজনের কাছ থেকে অগ্রীম বাবদ প্রায় ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় তারা।
এদেরই একজন হলো সভাপতির আপন খালাতো ভাই সৈয়দপুর শহরের কয়ানিজপাড়া ইসলামী কমপ্লেক্স সংলগ্ন আব্দুল জব্বারের ছেলে মাহফুজ (বাহাদুর)। সে পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। তাকে পিয়ন পদে নিয়োগ দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ১ লাখ টাকা নিয়েছেন।
একইভাবে বোতলাগাড়ী মাঝাপাড়ার নজরুল ইসলামের ছেলে মোরশেদুল ইসলাম জুয়েল কে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য গত বছরের জানুয়রীতে ৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষক সম্পর্কে চাচা হওয়ায় তাদের কথায় আস্বস্ত হয়ে কর্মসংস্থানের আশায় পরিবারের সকলে মিলে এই অর্থ প্রদান করেছে।
জুয়েলের মা মাজেদা বেগম জানান, আমার ছেলে এমএ পাশ। লেখাপড়া শেষ করেও কোন চাকুরী না হওয়ায় অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এমতাবস্থায় প্রতিবেশী দেবর বোতলাগাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোখলেছুর রহমান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেয়। তার কথায় অনেক কষ্টে গরু, জমি, আলু, ধান বিক্রি করে এবং আমার মেয়ে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে ৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দেই। কিন্তু প্রায় ২ বছর পার হয়ে গেলেও নিয়োগ না দেয়ায় পুরো পরিবার চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। এরই মধ্যে মাস্টার আত্মহত্যা করায় আমরা চরম বিপাকে পড়েছি।
এমনি করে মাহবুবের কাছ থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার, দেবু বাবুর নাতির কাছ থেকে ২ লাখ টাকাসহ আরও অনেকের কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়েছে। এসব টাকা নেয়ার পর দীর্ঘ দিনেও নিয়োগ বা টাকা ফেরত না দেয়ায় পাওনাদাররা প্রায়ই প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির কাছে ধর্ণা দেন। এতে নিজেকে আড়াল করতে তাদেরকে সভাপতি টাকার জন্য প্রধান শিক্ষককে চাপ দেয়ার পরামর্শ দেয়ায় প্রধান শিক্ষক চরম বেকায়দায় পড়ে যায়।
একটি সূত্র মতে, এই টাকা নিয়ে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের মধ্যে দীর্ঘ দিন থেকেই বিরোধ চলে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর বোতলাগাড়ী পোড়ারহাট বাজারে সভাপতি জুনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির মধ্যে ব্যাপক কথা কাটাকাটি হয়। সভাপতি এসময় প্রধান শিক্ষককে চরমভাবে অপমান করায় তিনি সেখান থেকে বিমর্ষ অবস্থায় চলে যান।
পরে এই বিষয় নিয়ে পারিবারিকভাবে আলোচনা করেন প্রধান শিক্ষক। ইতোমধ্যে গত ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে প্রধান শিক্ষক বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। এরপর থেকে সভাপতির নিয়োগ বানিজ্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সচেতন মহল এ ব্যাপারে তদন্ত পূর্বক এমন দূর্ণীতিবাজ আহ্বায়কের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দাবি জানিয়েছেন।
সাবেক কমিটির সদস্য ও বর্তমান এ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান সরকার জুন বলেন, উপরোক্ত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। নিয়োগ বানিজ্য করে থাকলে প্রধান শিক্ষক করেছেন। আমি কারো কাছ থেকে টাকা নেইনি। এসময় তার খালাতো ভাই বাহাদুরের বিষয় উল্লেখ করলে তিনি বলেন, তার কাছ থেকে প্রধান শিক্ষককে সুদের উপর টাকা নিয়ে দিয়েছি। ইতোমধ্যে তার অর্ধেক পরিশোধ করা হয়েছে।
এদিকে প্রধান শিক্ষকের আত্মহত্যা বিষয়ক সংবাদ প্রকাশ ও এক্ষেত্রে সভাপতির সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ইঙ্গিত করায় আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান জুন সংবাদকর্মীকে হাত পা ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি প্রদানসহ থানায় গিয়ে বাহাদুরের টাকা নেয়ার জবাব দেয়া হবে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কমেন্ট করেছেন। এর প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই প্রধান শিক্ষকের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন। তারা মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।